মাদখালী দলের জন্ম নিয়ে শায়খ বকর আবু যায়েদের ভবিষ্যদ্বাণী
ড. রাবী ইবনে হাদী আল-মাদখালী যখন তার দল তৈরির প্রথম পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন, তখন সাইয়্যেদ কুতুবের বিরুদ্ধে এক বই লিখেন। এই বই টা কেমন হলো তা জানতে চিঠি লেখেন সাঊদী আরবের সেরা আলিমদের সংস্থা “হাইয়াতু কিবারিল উলামা” এর প্রখ্যাত শায়খ ড. বকর আবু যায়দের কাছে।
তিনি ওই পান্ডুলিপি পড়ে খুব কষ্ট পান। সেই কষ্টের কথা তিনি তার এই চিঠিতে লিখে দেন। এই চিঠিকে (الخِطَابُ الذَّهَبِيُّ) “আল খিতাব আয যাহাবী” বা “সোনালী চিঠি” নামে সবাই চেনে। মাদখালীর এই সব বই উম্মাতের কি ক্ষতি করবে তার একটা ভবিষ্যদ্বাণী তিনি এখানে করে গিয়েছিলেন।
[চিঠিটার আরবী ভার্সনটা নিচের লিংকে ক্লিক করলে পেয়ে যাবেন।]
https://archive.org/details/20200729_20200729_1746
https://arabicpdfs.com/الخطاب-الذهبي-للعلامة-بكر-أبو-زيد-pdf/
“সম্মানিত ভাই শায়খ রাবী বিন হাদী আল-মাদখালী, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু
পরবার্তা, এতদসংগে পাঠানো “আদওয়া ইসলামিয়্যাহ আলা আক্বীদাতি সাইয়্যেদ কুতুব ওয়া ফিকরিহি” শিরোনামের বইটা পড়ে দেখার আশা আপনি করছেন। জানতে চেয়েছেন এতে আমার কোন মন্তব্য আছে কিনা। আমি জানতে চাচ্ছি, আমার মন্তব্য পেয়ে কি এই প্রজেক্টটাকে বন্ধ করে গুটিয়ে নেয়া হবে? কিংবা এইসবের বর্ণনা করা বাদ দেয়া হবে? নাকি এর আলোকে বইটা সংশোধন করে বইটা প্রকাশ ও প্রচার করবেন? অথবা এই কিতাব কি আপনার আখেরাতের জন্য একটা সঞ্চয় মনে করবেন? কিংবা দুনিয়াতে আল্লাহর বান্দাদের জ্ঞানের চোখ এতে খুলবে?
যাহোক, আপনার বই সম্পর্কে আমি আমার মন্তব্য
বলছিঃ
(১) আমি বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় সূচিপত্র দেখেছি, এতে যে শিরোনামগুলো পেলাম তা সাইয়্যেদ কুতুবের (রহ.)
ব্যাপারে এইভাবে বলা হয়েছেঃ কুফর, নাস্তিকতা ও যিন্দিকতা মূলক বক্তব্য, তার সর্বেশ্বরবাদের বক্তব্য, তার “কুরআন সৃষ্ট
হওয়ার” অভিমত, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আইন
প্রনয়নের অধিকার থাকা বৈধ হওয়া, আল্লাহ তাআলার
সিফাতের ব্যপারে তার বাড়াবাড়ি, মুতাওয়াতির হাদীস
গ্রহন করা যাবেনা বলে তার মত, আক্বীদায় যেসব
বিষয়ে দৃঢ়তার প্রয়োজন সে সব বিষয়ে সন্দেহবাদিতা, সমাজকে কাফির বলা ইত্যাদি।
এমনসব শিরোনাম ব্যবহার করা হয়েছে যা মুমিনদের রোমকূপ খাড়া দিয়ে ওঠে। আফসোস হচ্ছে সারা দুনিয়ার ঐসব আলিমদের জন্য, যারা সাইয়্যেদ কুতুবের এত বড় ঈমান বিধ্বংসী বিষয়গুলোতে সতর্ক হননি, অথচ সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ার মত সাইয়্যেদ কুতুবের কিতাব সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। এত সর্বজনগ্রাহ্যতার সাথে আপনার পাওয়া ভুলের সামঞ্জস্য আমি মিলাতে পারছি না। অথচ সাধারণ মুসলিমগণ এই বইসমূহ থেকে উপকৃত হয়েছে। এমনকি আপনিও কিছু কিছু লেখনীতে তার থেকে উপকৃত হয়েছেন। এই ক্ষেত্রে আমি আপনার দেয়া শিরোনামের সাথে বইয়ে লেখা বিষয়বস্তু মিলিয়ে দেখেছি। দেখলাম আপনি যা বলেছেন, বাস্তবতা তা নয়। শেষে বুঝেছি, আপনার দেয়া শিরোনামগুলো মূলতঃ সাধারণ মানুষের মনোযোগ সাইয়্যেদের ভুলের প্রতি আকর্ষণ করে উত্তেজনা ছড়াবার লক্ষ্যেই প্রণীত। আমি সর্বপ্রথম আমার জন্য, এরপর আপনাদের জন্য এবং প্রতিটি মুসলিম নাগরিকের জন্য এই ধরণের পাপ ও একদেশদর্শিতাকে অপছন্দ করি। আর এটা নির্লজ্জ প্রতারণা যে,একজন মানুষের ভালো দিক গুলোকেও তার শত্রু ও অপছন্দকারীদের হাতে খারাপ ভাবে তুলে ধরা।
(২) আমি দেখলাম, বইটাতে একাডেমিক গবেষণার মূলনীতি মেনে চলা হয়নি। জ্ঞানগত নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হয়নি। সমালোচনা সাহিত্যের প্রয়োগ ও পদ্ধতি অনুসৃত হয়নি। কোন বক্তব্য উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে আমানত রক্ষা হয়নি। বাস্তবতা ও সত্য হজম করার মানসিকতা এখানে দেখানো হয়নি। এছাড়াও আপনার লেখায় ডায়লগের আদব রক্ষা পায়নি। উন্নততর লেখনী কিংবা সাবলীল উপস্থাপনার সাথে আপনার বই এর সামান্যতম সম্পর্কও নেই।
প্রমান নিন ➤
প্রথমতঃ আপনি জেনেশুনে সাইয়্যেদের “ফী যিলালিল কুরআন” ও “ইসলাম ও সামাজিক সুবিচার” বইদ্বয়ের পুরনো প্রকাশনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যেমন আপনার বই এর পৃষ্ঠা ২৯। আপনি জানেন এই বই গুলোর পরবর্তী সংস্করণ ছিলো। এক্ষেত্রে আপনার সমালোচনার মূলনীতি ও জ্ঞানের আমানাত রক্ষা করা উচিত ছিলো। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি বইয়ের সর্বশেষ সংস্করণে লেখার টেক্সটকেই মূল ধরতে হয়। কারণ পরে যে পরিবর্তন আনা হয়, তা আগের সংস্করণের বক্তব্যকে রহিত করে দেয়। আর এই প্রাথমিক জ্ঞানটা, আল্লাহ চাইলে, আপনার অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু হয়ত আপনার যে ছাত্র এইসব তথ্যগুলো আপনার কাছে এনে দিয়েছে, সে আসলে ভুল করেছে এবং সে এটা বুঝেনি। এইসব ব্যপার যে ঘটে তা জ্ঞানীদের কাছে অজানা নয়। যেমন ধরুনঃ ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম এর কিতাব “আর-রূহ”, কেউ কেউ এই ব্যাপারে অভিমত রেখেছেন এটা তার প্রথম জীবনের কিতাব। অনুরূপ ভাবে “ইসলাম ও সামাজিক সুবিচার” সাইয়্যেদ কুতুবের ইসলামের বিষয়ে প্রথম দিককার লেখা। আল্লাহুল মুসতাআন।
দ্বিতীয়তঃ আমার রোমকূপ খাড়া হয়েছে যখন দেখেছি আপনি বইয়ের সূচিপত্রে লিখেছেন, “সাইয়্যেদ কুতুব আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো আইন প্রনয়ন বৈধ বলেন।”
আমি তক্ষুনি তার বক্তব্যের দিকে দ্রুত পাতা উল্টালাম। দেখলাম তার বই “ইসলামে সামাজিক সুবিচার” এর কয়েক লাইনের একটা উদ্ধৃতি। অথচ তার বক্তব্য মোটেই এই ধরণের উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অর্থ দেয়না। ধরে নেই তার বক্তব্যে কিছু দূর্বোধ্য বাক্য বা অনির্দিষ্ট কিছু বাক্য আছে, সেইটাকে কিভাবে আপনি কুফরি হবার বক্তব্যে পরিণত করবেন? এর দ্বারা আপনি সাইয়্যেদ কুতুব যে সত্যের উপর ভিত্তি করে আপন জীবন বানিয়েছেন, তার কলমকে আল্লাহর সার্বভৌমত্যের এবং আইন প্রনয়নের তাওহীদের দিকে দাওয়াতের জন্য ব্যবহার করেছেন, মানবরচিত আইনকে অগ্রাহ্য করে এই ধরণের আইন রচয়িতাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন – তাকে আপনি ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। আল্লাহ অবশ্যই ইনসাফ পছন্দ করেন, অথচ আপনাকে এ ক্ষেত্রে ইনসাফের বিপরীতে দেখতে পেয়েছি।
তৃতীয়তঃ এই ধরণের আরেক উত্তেজনাকর শিরোনাম হলোঃ “সাইয়্যেদ কুতুব সর্বেশ্বরবাদের পক্ষে মত দিয়েছেন।” আসলে সাইয়্যেদ সূরা হাদীদ ও সূরা ইখলাস এর তাফসীর করতে যেয়ে নিজস্ব পদ্ধতিতে কিছু রহস্যপূর্ণ কথার মালা গেঁথেছেন। যা থেকে তিনি সর্বেশ্বরবাদে বিশ্বাসী এমন কথা বলা হয়।
তবে আপনি খুব ভালো করেছেন সূরা বাকারাহ-য় সাইয়্যেদ সর্বেশ্বরবাদ সম্পর্ক স্পষ্ট বিরোধিতা উল্লেখ করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেনঃ “এখানেই ইসলামের সঠিক দর্শন সর্বেশ্বরবাদী দর্শনকে তিরোহিত করে দেয়”। আমি আরো বলি, তার বই “মুক্বাওয়ামাত তাসওয়ূরুল ইসলামি” গ্রন্থে সাইয়্যেদ সর্বেশ্বরবাদিতার জোরালো বিরোধিতা করে বিস্তারিত জওয়াব দিয়েছেন। এই জন্য বলি, আল্লাহ সাইয়্যেদ কুতুবের রহস্যপূর্ণ এমন কথা ক্ষমা করে দিন যা বক্তব্যের মারপ্যাঁচে তিনি হয়ত কিছু একটা বুঝাতে চেয়েছেন। তবে সর্বেশ্বরবাদিতা ভুলের ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য থাকলে এই ধরণের হেঁয়ালি কথার টানাটানি করতে হবে কেন? আমি আশা করবো তাড়াতাড়ি আপনি সাইয়্যেদকে কাফির বানানো বক্তব্য প্রত্যাহার করুন। মনে রাখবেন, আমি আপনাদের কল্যানকামী।
চতূর্থতঃ এখানে আমি আপনার সদয় অবগতির জন্য স্পষ্ট করে বলতে চাই, আপনি যে শিরোনাম দিয়েছেনঃ “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুর ব্যখ্যায় সাইয়্যেদ কুতুব অন্যন্য উলামায়ে কিরাম ও ভাষা তাত্ত্বিকদের বিপরীতে গেছেন, এবং তার কাছে রুবুবিয়্যাত ও উলুহিয়্যাতের বিষয় স্পষ্ট হয় নি......”
প্রিয়ভাজন, আপনাকে বলি, আপনি প্রমান ছাড়াই সাইয়্যেদের তাওহীদ ও তাওহীদ সংক্রান্ত বিষয়াবলীর আলোচনা, এবং তাওহীদের সম্পূরক ঐসব বিষয়, যা তার সারা জীবনে প্রমাণ করে গেছেন- তা ভেঙে দিয়ে শেষ করেছেন।
সাইয়্যেদ বলেছেন, “তাওহীদের কালিমার দাবী হলো, আইন ও আইন প্রণয়নের ব্যাপারে আল্লাহর একত্ববাদের স্বীকৃতি দেয়া” তার এই একটা কথা ই আপনার সমস্ত কথা অন্ত্যসারশুন্য করে দেয়। এই ব্যাপারে সাইয়্যেদ (রহ.) অনেক বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ তিনি দেখেছেন আল্লাহর আইনের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে বিচারালয় বা অন্যান্য আইনী সংস্থা। আল্লাহর আইন বাতিল করার মত ধৃষ্টতাও তারা দেখাচ্ছে। তারা আল্লাহর আইনের পরিবর্তে মানব রচিত আইনকে হালাল সাব্যস্ত করতে উঠে পড়ে লেগেছে। আর সত্যি বলতে কি, ১৩৪২ হিজরীর আগে মুসলিম জাতির সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এমন মারাত্মক ধৃষ্টতা আর দেখানো হয়নি।
পঞ্চমতঃ আপনি সূচিপত্রের আরেকটা শিরোনাম দিয়েছেনঃ “সাইয়্যেদ বলেছেন, “কুরআন সৃষ্ট”। তিনি নাকি বলেছেনঃ “আল্লাহর কথা মানে হলো আল্লাহর ইচ্ছা”…… আমি যখন আপনার বই এর মূল পৃষ্ঠায় গেলাম, পড়ে একটা অক্ষরও পেলামনা যাতে বুঝা যায় সাইয়্যেদ (রহ.) “কুরআন সৃষ্ট”এই শব্দটি স্পষ্ট ব্যবহার করেছেন। কিভাবে এত সহজে আপনি তাকে এই ধরণের কুফরি কথার তোহমাত দিতে পারলেন? আমি শেষে যা দেখলাম তা হলো, তার লেখার স্টাইলে এই ধরণের একটু ইংগিত পাওয়া যায়। যেমন সাইয়্যেদ কুতুব বলেছেনঃ “কিন্তু তারা (কাফিররা) এইসব অক্ষর সমূহ (হুরুফে মুকাত্তাআত) দিয়ে কুরআনের মত রচনা করতে পারেনা। কারণ কুরআন হলো আল্লাহ কৃত, মানুষকৃত নয়”…… সন্দেহ নেই, এই “কৃত” শব্দটা একটা ভুল প্রয়োগ। কিন্তু এই শব্দের কারণেই কি আমরা বলতে পারবো সাইয়্যেদ এই শব্দ দিয়ে “কুরআন সৃষ্ট” এমন কুফরী কথা বলেছেন? না, আমি ঐ প্রকার অর্থে নিশ্চিত হতে পারিনা। আপনার এই কথা শায়খ আব্দুল খালেক্ব উদ্বায়মাহ (র) এর “দিরাসাত ফী উসলূবিল ক্বুরআন” নামক বিশ্বকোষের ভূমিকায় এই ধরণের একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। এই গ্রন্থটা আলইমাম ইউনিভার্সিটি প্রকাশ করে ধন্যবাদার্হ হয়েছেন। তিনিও এই শব্দ ব্যবহার করেছেন, এই ধরণের শব্দ প্রয়োগের কারণে কি আমরা সবাইকে বলবো “আপনি কুরআন সৃষ্ট” আক্বীদাহ পোষণ করেছেন? না, কক্ষনোই না। আমি আপনার গবেষণায় এই “অব্জেক্টিভিটি”-র দিকে দৃষ্টি দিতে পরামর্শ দেব। এই উদাহরণই এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ। মনে রাখবেন, গবেষণায় এটা খুবই জরুরি।
আমার আরো কিছু বক্তব্য আছে, যা নিচে বর্ণনা করা হচ্ছেঃ
(১) কিতাবটার মুসাবিদা হাতে লেখায় ১৬১ পৃষ্ঠা হয়েছে। কিন্তু দেখলাম এর হাতের লেখার ধরণ বিভিন্ন। সাধারণতঃ যা হয়, তার ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এর একটা পৃষ্ঠাও আপনার লেখা না। অবশ্য হতে পারে আপনার হাতের লেখা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে, অথবা আমারই মতিভ্রম হয়েছে। অথবা হতে পারে সাইয়্যেদ কুতুব (র) এর বই গুলোকে কিছু ছাত্রের উপর ভাগ করে দেয়া হয়েছিলো, তারাই আপনার তত্ত্বাবধানে সেইসব কিতাব থেকে তথ্য- উপাত্ত সংগ্রহ করেছে, অথবা আপনার ডিক্টেশান নিয়ে তারা লিখেছে। এই জন্য আমার কাছে এটা আপনার লেখা প্রমাণ করা কষ্ট হচ্ছে। অবশ্য আপনি ফ্রন্ট পেইজে লিখেছেন এই বই আপনার লেখা, কাজেই আমি মেনে নিচ্ছি এটা আপনার লিখিত বই।
(২) হাতের লেখা বিভিন্নতা সত্ত্বেও বইয়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যে স্রোতধারাই বহমান, তা হলো এর ভেতর থেকে আমরা অনুভব করি এক উত্তেজিত মন, সেখানে ভরা অনিরুদ্ধ ক্ষোভ, ও এমন আক্রমন যা লেখকের বক্তব্যকে সংকুচিত করে বড় বড় ভুল বের করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে সংশয়ের স্থান বা অনুক্ত বক্তব্যকে বানানো হয় যেন সংশয়াতীতভাবে বলা এমন কোন কথা, যাতে কোন দ্বিমতের সুযোগ নেই। এটা “নিরপেক্ষতা” নামক সমালোচনা সাহিত্যের স্বতঃসিদ্ধ পদ্ধতির বরখেলাপ।
(৩) সাইয়্যেদের লেখার স্টাইলের সাথে এই বই যে কেউ তুলনা করলে দেখতে পাবে কত নিম্নমানের আপনার লেখা। সাইয়্যেদের লেখার মান কত উঁচু। আপনার পাঠানো এই বই যদি মেনে নেই আপনারই, তা হলে বলবো এটা একজন প্রি-ইউনিভার্সিটি ছাত্রের মানে হতে পারে। একজন বিশ্বমানের সার্টিফিকেটধারীর জন্য এ লেখা মানায় না। সাইয়্যেদের সমালোচককে সাহিত্য রুচির দিক দিয়ে, ভাষার অলংকার ও বর্ণনা শৈলীতে এবং সুন্দরতম উপাস্থাপনার ঢঙে অন্ততঃ তার পাশে যাবার যোগ্যতা থাকতে হবে। তা না হলে কলম ভেঙে ফেলা উচিৎ।
(৪) আপনার লেখার মধ্যে অযাচিত উত্তেজনার আধিক্য আছে যেমন, তেমনই দেখা যায় “সমালোচনার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির” উপর আপনার ভীতি। এইজন্য “ডায়লগের” আদব রক্ষা পায়নি।
(৫) এই বই এর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আক্রমণ, জলাতংকের সংক্রমন এবং ভাষার ব্যবহারে মারাত্মক কাঠিন্য। কেন এটা?
(৬) আপনার এই কিতাব বের হলে নতুন একটা “দলের” উদ্ভব হবে, যার যুবক সদস্যদের হৃদয় ভরা থাকবে চিন্তার ভ্রষ্টতা দিয়ে। যারা কথায় কথায় এটা ওটা হারাম বলবে, যেকোনো জিনিসের খামাখা বিরোধিতা করবে। কথায় কথায় তাদের উক্তি হবে এটা বিদআত, ঐটা বিদআতী, এটা পথভ্রষ্টতা, ঐটা পথভ্রষ্ট …...
যারা তাদের বক্তব্য প্রমানের জন্য যথেষ্ঠ দলিলের পরোয়া করবেনা। “নিজেরা বেশি দ্বীনদার” এই অহংকার ও দাম্ভিকতা তাদের দিলে জন্ম নেবে। এদের কাজ দেখে মনে হবে এদের একেক জন যেন এইসব করে তাদের ঘাড়ের বোঝা ঝেড়ে ফেলতে চাচ্ছে। এরা একেকজন যেন সমগ্র উম্মাতকে গর্ত থেকে উঠানোর ত্রাতা হয়ে এসেছে। পবিত্র শরীয়াতের সম্মান বাঁচাতে অন্যদেরকে তারা মনে করবে জাত্যাভিমানহীন বা তাক্বওয়াহীন। এটা তাদের বাস্তব বিবর্জন, বরং এটা আসলেই ধ্বংস, যদিও এটাকে মনে করা হবে উঁচু ব্যালকনী দেয়া বিল্ডিং বিনির্মান। কিন্তু আসলে এটা ভেঙে ফেলা, এরপরে মাতাল ঝড়ের কোন এক সোপানে একসময় ঠান্ডা হয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া।
— এই ৬টা বৈশিষ্ট্য দিয়ে সাজানো বইটা আসলেই সুখপাঠ্য নয়। আপনারই আকাঙ্ক্ষা আমি বইটা পড়ি। তবে বইটা পড়ে এটাই আমার কাছে মনে হয়েছে। জওয়াব দিতে দেরি হওয়ায় আমি দুঃখিত, কারণ ইতিপূর্বে এই লোকের (সাইয়্যেদ কুতুবের) কোন লেখা যত্ন সহকারে পড়া আমার হয়নি। যদিও মানুষ সেগুলো পড়ে।
আপনার লেখার ভয়াবহতা আমাকে তার প্রায় বইগুলো কয়েক মর্তবা পড়তে আগ্রহী করেছে। আমি তার গ্রন্থে অনেক কল্যান পেয়েছি, দীপ্যমান ঈমান পেয়েছি, উজ্জ্বল হক্ব পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি ইসলামের শত্রুদের মারাত্মক পরিকল্পনাসমূহ ফাঁস করে দেয়া ব্যাখ্যা।
যদিও তার বক্তব্যের মাঝে, এবং কিছু বাক্যের মাঝে কিছু ভুল পেয়েছি। মনে হয়েছে যদি তিনি এগুলো না উচ্চারণ করতেন! অবশ্য এর অনেক গুলোর ব্যাপারে তিনি অন্যত্র স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন তাতে আগের কথা অপনেয় হয়ে যায়। মনে রাখতে হবে কোন ব্যাক্তির পরিপূর্ণতা সহজ বিষয় নয়। আর তিনি একজন সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক ছিলেন। এরপর তিনি কুরআন কারীম, হাদীস শরীফ ও সীরাতুন্নাবী (সা) অধ্যয়নের মাধ্যমে ইসলামের খিদমাতের দিকে মুখ ফেরান। ফলে তার যুগের বিভিন্ন বিষয়ে তাকে অবস্থান নিতে হয়, এবং আল্লাহর পথে তার অবস্থানে তিনি অনড় ছিলেন।
একসময় তার আগের লেখা বিষয়গুলো প্রকাশ করা হয়। একসময় এমনকি তাকে এমন কিছু লিখতে বলা হয় যাতে মাফ চাওয়া বুঝায়। তিনি তখন তার সেই প্রসিদ্ধ বক্তব্য প্রদান করেনঃ যে অঙ্গুলি আমি শাহাদাত উচ্চারণের জন্য উঁচু করি, তা দিয়ে আমি এমন একটা শব্দও লিখতে পারবোনা, যা সেই শাহাদাতেরই বিপরীতে দাঁড়ায়”। আমাদের সবার উচিৎ তার মাগফিরাতের জন্য দুয়া করা, তার জ্ঞান থেকে উপকৃত হওয়া এবং তার যেসব ভুল আমাদের কাছে প্রমানিত হয়েছে তা পরিস্কার করা। তার করা ভুল যেন তার জ্ঞান থেকে উপকার বঞ্চিত না করে আমাদের। এই ভুলের কারণে তার বইগুলোকে ত্যাগ করতে বাধ্য না করা হয়।
আল্লাহ আপনাকে হিফাযাত করুন, আপনি তার অবস্থা আমাদের অতীত হওয়া সালাফদের অবস্থার মত মনে করুন। যেমন আবু ইসমাঈল আল হারাওয়ী এবং আব্দুল কাদির জিলানী। শায়খুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ কিভাবে তাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন, অথচ কত মারাত্মক ভুল তাদের ছিলো। শায়খুল ইসলাম তাদের পক্ষপাতিত্ব করেছেন, কারণ এই দুইজনের মূল কাজ ছিলো ইসলাম ও সুন্নাহকে সাহায্য করা। আপনি আল হারাওয়ীর (র) “মানাযিল আল সাইরীন” বইটা দেখুন। দেখবেন সেখানে এমন কিছু রোমকূপ শিউরে দেয়া কথা আছে যা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এতদসত্বেও ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) এই বই এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ “মাদারিজুস সালেকীন” এ তার পক্ষ থেকে কত কাকুতি করে মাফ চেয়েছেন এবং তাকে এ ব্যাপারে অপরাধী বানাননি। আমি এই ব্যাপারে আমার বইয়ে “তাসনীফ আন নাস বায়না আল যান্ন ওয়াল ইয়াক্বীন” (ধারণা ও বিশ্বাসের মাঝে মানুষকে শ্রেনীবদ্ধ করা) যতটুকু পেরেছি, মূলনীতি আলোচনা করেছি।
সবশেষে সম্মানিত ভাই, আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি, “আদওয়া ইসলামিয়্যাহ” নামের এই বইটা প্রকাশ করা থেকে নিবৃত্ত হোন। আসলে এটা প্রকাশ ও প্রচার করা বৈধও না। কারণ এতে আছে মারাত্মক আক্রমন। এর দ্বারা আপনি উম্মাতের যুবকদের উলামাদের ভুল খোঁজার জন্য, তাদের কেটে ছিড়ে ফেলার জন্য, তাদের অপমান করার জন্য, এবং তাদের মর্যাদাকে ভূলণ্ঠিত করার জন্য জঘন্যভাবে প্রশিক্ষিত করে তুলবেন।
আল্লাহ আপনাকে বরকত দিন, আপনাকে যদি কঠিন কথা কষ্ট দিয়ে থাকি মাফ করবেন। এটা করেছি কারণ এ বইতে আমি মারত্মক আক্রমণ দেখতে পেয়েছি। আমার স্নেহ গ্রহণ করুন, আপনার বইয়ের ব্যাপারে আমার মত জানার জন্য বারবার আগ্রহ প্রকাশ কারণে আমার কলম দিয়ে এই কথাগুলো বের হলো।
আল্লাহ আমাদের সকল পদক্ষেপ সোজা করে দিন। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।